হাদিস ও বিজ্ঞানের আলোকে উপুড় হয়ে শোয়ার বিষয়ে গভীরতর অনুসন্ধান


আমরা প্রত্যেকেই জানি, ঘুম মানুষের জন্য অত্যন্ত জরুরী। একদিনের ক্লান্তি দূর করে, শরীর ও মনকে করে প্রাণবন্ত। 

মানুষের আরামের জন্য আল্লাহ তায়ালা ঘুম দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে আবরণ ও নিদ্রাকে আরামপ্রদ করেছেন এবং দিনকে করেছেন জাগ্রত থাকার সময়।’ ( সূরা আল-ফুরকান, (২৫), আয়াত, ৪৭)

অপর এক আয়াতে বর্ণিত হয়েছে,  ‘আর তিনি রাতকে মানুষের প্রশান্তির উপায় হিসেবে সৃষ্টি করেছেন’। (সূরা আনআম, আয়াত, ৯৬)

 
সূরা নাবায় আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,  ‘আর তোমাদের ঘুমকে ক্লান্তি ঘুচানোর উপায় বানিয়েছি’। (সূরা নাবা, আয়াত, ৯)

কিন্তু ঘুমানোর একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যা আমাদের ইসলাম শিখিয়েছে। হাদিস শরীফে ঘুমানোর বিভিন্ন আদব ও নিষেধাবলি বর্ণিত আছে। আজকে আমরা এমন একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব, যা অনেকেই হয়ত জানেন না।

হাদিসের ব্যাখ্যা:
"ঘুমানোর সময় কিংবা বিশ্রামের জন্য কখনো উপুর হয়ে বুকের উপর ভর দিয়ে না ঘুমানো। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উপুর শুতে নিষেধ করেছেন।  এর কারণ হিসেবে হাদিস শরিফে দুটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।

 
এক. মহান আল্লাহ এভাবে শোয়া পছন্দ করেন না।
দুই. এটি জাহান্নামিদের শোয়া।


হাদিসের একাধিক বর্ণনায় এসেছে-
> ‘উপুর হয়ে বুকের উপরে ভর দিয়ে শোয়া নিষিদ্ধ, কারণ শয়তান এইভাবে শোয়।’ (বুখারি)"

জাহান্নামিদের উপুড় করেই জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। ইবনে তিখফা আল-গিফারি  (রহ.) থেকে বর্ণিত, তার পিতা তাকে অবহিত করেন যে তিনি ছিলেন আসহাবে সুফফার সদস্য। 

তিনি বলেন, একদা শেষ রাতে আমি মসজিদে ঘুমন্ত অবস্থায় ছিলাম। আমি উপুড় হয়ে ঘুমে বিভোর অবস্থায় একজন আগন্তুক আমার নিকট এলেন। তিনি আমাকে তাঁর পায়ের সাহায্যে নাড়া দিয়ে বলেন, ওঠো! এই উপুড় হয়ে শুলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন। আমি মাথা তুলে দেখি যে রাসুল (সা.) আমার শিয়রে দাঁড়িয়ে। (আদবুল মুফরাদ, হাদিস, ১১৯৯)

অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু জর (রা.) বলেন, আমি উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় নবী (সা.) আমার পাশ দিয়ে গেলেন। তিনি আমাকে তার পা দ্বারা খোঁচা মেরে বলেন, হে জুনাইদিব! এটা তো জাহান্নামের শয়ন। (ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩৭২৪)


রাসুল (সা.)-এর বাণী—‘এটা তো জাহান্নামের শয়ন’—এর পক্ষে পবিত্র কোরআনের আয়াতও পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে জাহান্নামিদের প্রতি ইরশাদ হয়েছে, ‘যেদিন তাদের উপুড় করে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে জাহান্নামের দিকে; সেদিন বলা হবে, জাহান্নামের যন্ত্রণা আস্বাদন করো।’ (সুরা কমার, আয়াত, ৪৮)


বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি:
যদিও এই হাদিসের মূল উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক, তবে বিজ্ঞানও এই ভঙ্গিতে শোয়ার কিছু নেতিবাচক দিকের কথা বলে। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, উপুড় হয়ে শোয়ার কারণে কয়েকটি সমস্যা দেখা দিতে পারে:


শ্বাসকষ্ট: উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে বুকের উপর চাপ পড়ে, যার ফলে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে হাঁপানি, অ্যাজমা বা অন্যান্য শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য এটি আরও বেশি সমস্যাজনক।


মেরুদণ্ডের সমস্যা: দীর্ঘ সময় ধরে উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে মেরুদণ্ডে চাপ পড়ে এবং এর ফলে পিঠে ব্যথা, ঘাড়ে ব্যথা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে।


রক্ত সঞ্চালনে বাধা: এই ভঙ্গিতে শোয়ার ফলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষ করে হৃদরোগীদের জন্য এটি ক্ষতিকর হতে পারে।


মুখের উপর চাপ: উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে মুখের উপর চাপ পড়ে, যার ফলে মুখে ব্যথা, চোখে ব্যথা এবং শ্বাসনালীর সমস্যা হতে পারে।

মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ:


স্বপ্ন: কিছু মনোবিজ্ঞানী মনে করেন, উপুড় হয়ে শোয়ার ফলে ভয়ানক স্বপ্ন দেখার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। কারণ এই ভঙ্গিতে শ্বাসকষ্ট হতে পারে এবং শরীরে অস্থিরতা বোধ হয়, যা ভয়ানক স্বপ্নের কারণ হতে পারে।


মানসিক চাপ: দীর্ঘদিন ধরে একই ভঙ্গিতে শোয়ার ফলে মানসিক চাপ বাড়তে পারে।


উপসংহার:


আশা করি, এই আলোচনার মাধ্যমে আপনারা উপুড় হয়ে বুকের উপর ভর দিয়ে শোয়ার ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছেন। হাদিসে এই নির্দেশনা আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। তাই আজ থেকেই আমরা সবাই মিলে এই সুন্নত আমলকে আমাদের জীবনে বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করব।


উপস্থাপিত আলোচনা দ্বারা স্পষ্টভাবে বলা যায় যে উপুড় হয়ে বুকের উপর ভর দিয়ে শোয়া নিষিদ্ধ, কারণ শয়তানও এই ভঙ্গিতে শোয়। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি নিষেধাজ্ঞা, যার পেছনে গভীরতর আধ্যাত্মিক ও নৈতিক কারণ থাকতে পারে।


রিয়াজ উদ্দিন

No comments

Powered by Blogger.